ঠিক পূজোর মধ্যেই পালাবো ভেবেছিলাম। ব্যাগ গুছোনো, সাইকেল রেডি, উত্তেজনায় পেট গুড়গুড়ও করছে। সপ্তমীর ভোরের প্ল্যান পুরো ছকে বাঁধা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে বর্ধমান হয়ে, দুর্গাপুর পেরিয়ে, পুরুলিয়ার রাস্তা - হাওয়া আর গণ্ডায় গণ্ডায় চা খেতে খেতে।
বাধ সাধলো পেট!
পোকামাকড় ঢুকেছিলো নিঘঘাত, একেবারে পেড়ে ফেললো, ঠিক ষষ্ঠীর রাত থেকে!
ব্যাস! পুরো পূজো চটকে চাট! রোজ সন্ধ্যেতে, গঙ্গার ঘাটে বসে কচি জোড়াদের ঘন প্রেম দেখে ফ্রাস্ট্রেশন বাড়িয়েই গোটা পূজোটা কেটে গেলো! কোথায় ভেবেছিলাম গোটাকয়েক সাঁওতাল মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবো নবমীতে, সেটা আর…
আমার যে মাঝেমধ্যেই কিছু বাই চাপে, সেটা এতদিনে আর অজানা নেই পাঠকদের, আশা করি।
তা, এটাও সেরকমই একটা বাই চাপার ফল ছিলো।
ইয়ে, মানে, পুরুলিয়া যাবার প্ল্যানটা, পেট খারাপেরটা নয়!
প্ল্যানটা ছিলো পুরুলিয়া গিয়ে একদিন শহরটা দেখা, তারপরে সোজা অযোধ্যা পাহাড় (বুরু, স্থানীয় ভাষায়)। ওখানে দিনকয়েক কাটিয়ে, হাওয়াটাওয়া আর পাহাড়ী খাবারদাবার খেয়ে, বনেজঙ্গলে ঘুরে, আবার নিচে নামা।
তা যাই হোক, অনেক ধস্তাধস্তি করে, অ্যালো আর হোমিও করে, পেটটা সারানো গেলো বেশ কদিন পরে। আর ঠিক সেই সময়তেই ফোন এলো আমার পুরুলিয়ার এক বন্ধুর – আমাকে দরকার পুরুলিয়ার এক গ্রামে, সেখানে এক বাচ্চাদের আশ্রমে, কিছু কাজে হাত লাগাতে হবে।
ব্যাস, পেটও ঠিক, আহ্বানও উপস্থিত, আর আটকায় কিসে!
বেরিয়ে পড়লাম এক রবিবার, সফরে।
যাত্রাপথের বিশাল বর্ণনা দিয়ে পাঠকদের বোর করার কোন মানে দেখছি না আমি, তাই শুধু এটুকু বলি যে, পরিকল্পিত পথেই এগোচ্ছিলাম, রাস্তায় বারংবার চায়ের ঠেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে। দিব্যি লাগছিলো পথের ধারের ছোট্ট দোকানে মুড়ি–ঘুগনি খেতে, কাচালঙ্কা সহযোগে, আর লোকের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে।
সাইকেল নিয়ে লম্বা সফরের বেরোনোর একটা দিক হচ্ছে আপনাকে হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। আমার গোটা যাত্রাপথে আমাকে নিয়ে যা কৌতূহল দেখানো হয়েছে রাস্তায়, সইফ–করিনার ছেলে তৈমূরের হিংসা হতে বাধ্য!
তো, এইসব ছোটোখাটো পাহাড় পেরিয়ে, সোমবার পড়লাম পুরুলিয়ার আসল পাহাড়ের সামনে। যারা ভ্রমণপিপাসু, তাদের জানিয়ে রাখি, ওদিকে গেলে, রাণীগঞ্জ থেকে যে রাস্তাটা পুরুলিয়ার দিকে গেছে, শালতোড়ার জঙ্গল দিয়ে, ওইটা ধরবেন। একবার গিয়ে দেখুন, আমাকে ধন্যবাদ ফিরে এসে দেবেন নাহয়!
পাহাড় শুনে ভয় পাবেন না যেন! আমি সাইকেল নিয়ে গেছিলাম, তাই একটুআধটু চড়াই ভাঙতে হয়েছিলো, আপনারা গাড়ি নিয়ে গেলে যা করার গাড়িই করবে, সুতরাং নিশ্চিন্তে যান। আর এমনিতেই পাহাড় না বলে, টিলা বলাই উচিৎ, তাই চড়াইও এমন কিছু নয়।
তো, এই শালতোড়ার রাস্তা ধরে দিব্যি পেরিয়ে গেলাম মাইলের পর মাইল রাস্তা। রাস্তার আর তার দুপাশের বর্ণনা আমি দেবো না, ওটা নিজেদেরকে গিয়ে দেখতে হবে। শুধু এটুকু বলতে পারি, বারবার মনে হয়েছে, এখানেই একটা ছোটো বাড়ি করে থেকে যাই!
কোনওরকমে সেই মোহ কাটিয়ে পুরুলিয়া শহরে পৌঁছে গেলাম সন্ধ্যের মুখে। ছোটো শহর, দিব্যি গমগমে। এক ভদ্রলোকের নম্বর ছিলো, যোগাযোগ করলাম থাকার জন্যে। ওনার লজ এ উঠে গেলাম কিছু অল্প ধ্বস্তাধ্বস্তির পর, মাত্র ৩৫০ টাকায় দুর্দান্ত রুম পেলাম। ভদ্রলোকটি পূর্বপরিচিত ছিলেন না, কিন্তু কতটা আপন হয়ে গেলেন একদিনের মধ্যে, সেটা নিয়ে এই ছোটো পরিসরে লেখা অসম্ভব, তাই পরে কোনদিন এই নিয়ে একটা আলাদা লেখার ইচ্ছে রইলো।
পুরুলিয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে, চক বাজার, লজের অবস্থান। পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, পরিচিত দাদার সাথে সাইকেলে শহর পরিদর্শন, লজের ছাদ থেকে শহরটাকে দেখা, পড়ন্ত বিকেলে লজের ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে ঘোরাঘুরি করা মেয়েকে ঝাড়ি মারা, সঙ্গে সূর্যাস্ত, ইতিউতি ভাবড়া (স্থানীয় এক নোনতা খাবার, অনেকটা জিলিপির মত দেখতে) আর লবঙ্গলতিকা খেয়ে বেড়ানো, আর জীবনে পরিচিত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ভরতে থাকা – এই নিয়েই পুরুলিয়া শহরের দুটো দিন কেটে গেলো দেখতে দেখতে।
বেরিয়ে পড়লাম দুদিন পরে, আরেক ভোরে – আমি মাথার পোকা নড়া মানুষ, শহরে বেশীদিন মন টেকে না!
এবার লক্ষ্য, অযোধ্যা পাহাড়।
সঙ্গে আরেক নব্যলভ্য ভাই, সে আমাকে কিছুটা রাস্তা সঙ্গ দেবে বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। শহর থেকে বেরোতে, দুলমি রোড ধরে এগিয়ে, কাঁসাই নদী (ওই, কংসাবতী) পেরিয়ে দিব্যি চলেছি। গোটা পনেরো কিমি যাবার পর, মূল রাস্তা ছেড়ে ডাইনে বাঁক নিতে হবে এবার। সঙ্গের ভাইটিকে জিগ্যেস করলাম, তুমি কোন জায়গা থেকে ফিরবে? একমুখ হাসি নিয়ে তার উত্তর – “ভাবছি অযোধ্যা টা আরেকবার ঘুরেই আসি!”।
পাগলদের সঙ্গে পাগলরাই জোটে।
সাধারণত অযোধ্যা হিলটপ যাবার পাকা মাখন সড়ক হচ্ছে সিরকাবাদ থেকে বাঁদিকে। চড়াই অপেক্ষাকৃত কম, কারণ রাস্তাটা অনেক আগে থেকেই উপরের দিকে উঠেছে। আমরা ছিটিয়াল, কখন হ্যাজাতে হ্যাজাতে সেই মোড় পেরিয়ে গেছি, কেউ খেয়ালই করিনি! ম্যাপে দেখি, ওই রাস্তা ধরতে গেলে প্রায় ৭–৮ কিমি পেছনে যেতে হবে আবার।
প্রাণে এলো ল্যাদ!
স্থানীয় লোককে জিগ্যেস করলাম। পশ্চিমে হাত দেখিয়ে বলল – “হুই যে ডুংরী দেখা যাচ্ছে, ওইদিকে যান। এই সামনে থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরুন, কম হবে”। ও হ্যাঁ, ডুংরী মানে টিলা, স্থানীয় ভাষায়।
ভালো কথা, কম চড়াই হবে বলছে, আর কি চাই!
ধরলাম রাস্তা। দিব্যি চারিদিকে ক্ষেত, গাছপালা, একটা ছোট্ট বাঁধও (টিলাইত্যাড়)। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। বাঁধ পেরোতেই কেসটা গেল গণ্ডগোল হয়ে। শুরু হল চড়াই – আর বাপরে বাপ, কি প্রাণান্তকর সে চড়াই! পায়ের গুলি ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়তে শুরু করলো, আর মুখ দিয়ে ফুসফুস বেরিয়ে আসার জোগাড়! যে লোকটা বলেছিলো যে কম নাকি, তাকে খুঁজতে খুব ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু তার জন্যেও আবার ফিরতে হবে ভেবে, সে পরিকল্পনাটা ত্যাগই করলাম আমরা। এবং খানিক পর, একটু সমতল পেতে, হাঁফ ছেড়ে, খেয়াল হল, যে লোকটা বলেছিলো “কম“, সেটা রাস্তার চড়াই না রাস্তার দূরত্ব, সেটা কিন্তু বলেনি! এবার বুঝলাম, যে যার মত বলেছে, আর যে যার মত বুঝেছে! এইজন্যে বলে, ধরে নিতে নেই!
যাই হোক, সব কষ্টেরই শেষ আছে। মিনিট কুড়ি প্রাণান্তকর চড়াই ঠেলে ওঠার পর, অবশেষে একটু কম চড়াই পাওয়া গেলো। আমাদের কাছে তখন ওটাই সমতল! আর পূজোর বোনাসের মত, একটা চায়ের দোকানও পাওয়া গেলো। ধড়ে যেন প্রাণ এলো। দুকাপ চা, আর গোটাষাটেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, বাকি ৬–৭ কিমি পথ মেরে দেবার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।
অযোধ্যা হিলটপ বেশ সমতল জায়গা। আমার থাকার বুকিং ছিলো না আগে থেকে, কিন্তু ইয়ুথ হোস্টেলটা টার্গেট করা ছিলো। খুঁজেপেতে গিয়ে দেখলাম যে থাকার ব্যবস্থা বেশ ভালো, এবং সস্তা তো বটেই। ওখানে দাঁড়িয়েই বুকিং করে নিলাম অনলাইনে। আজ্ঞে হ্যাঁ, স্পট বুকিং হয় না ইয়ুথ হোস্টেলগুলোতে, সেই বুঝে প্ল্যান করবেন আপনারা।
পরের কদিন, মানে ওই দুতিনদিন ধরুন, দিব্যি কাটালাম অযোধ্যাতে। কখনও হোস্টেলের পেছনের টিলার জঙ্গলের মধ্যে হাঁটা, হাতীর পালের ভয় মাথায় নিয়ে, আবার কখনও পাশের মাঠে স্থানীয় ছেলেদের প্রতিদিনের ফুটবল ম্যাচ দেখা, আবার একদিন সাইকেলে করে আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম হয়ে বাঘমুন্ডির দিক থেকে ঘুরে আসা। তবে প্রতি সন্ধ্যেতে, হোস্টেল থেকে ৩০০ মিটার দূরে, স্থানীয় লোকেদের চায়ের আড্ডায়, আগুনের সামনে বসে, চা আর পকোড়ী খেতে খেতে ঘণ্টা দেড়েক কাটাবার যে মজাটা পেয়েছিলাম, সেটার তুলনা পাওয়া অসম্ভব।
এইভাবে কেটে গেলো সুন্দর আর তিনটে দিন। এবার নামার পালা। নিচের দিকে, যে রাস্তায় এসেছিলাম, ওতেই গোটা কুড়ি কিমি নামলে এক পুঁচকে গ্রাম, নাম ভালিডুংরি। গন্তব্য সেইখানে – এক আশ্রমে, বাচ্চারা থাকে সেখানে, পড়ে, খেলে, নাচগান করে, সামনের রুক্ষ টিলায় গাছ লাগিয়ে সেটাকে সবুজ করে তোলে – এক ঝুমুর গায়কের তত্ত্বাবধানে। বিকেলের দিকে পৌঁছে গেলাম সেখানে। কিছুক্ষণ পরে চলে এলো আমার সেই বন্ধুটিও, যার আমন্ত্রণে এখানে আসা। আর এর মধ্যেই আশ্রমের ছেলেপুলেরা আমার সাইকেলটা সম্বন্ধে পুরোপুরি জেনে ফেলেছে, এবং চালিয়েও ফেলেছে পালা করে, আর আমাকে বানিয়ে ফেলেছে জিগরি দোস্ত!
এরপরেও জিগ্যেস করবেন না আমাকে যে আমি এত রাস্তায় কেন ঘুরেবেড়াই!
এরপরের দুদিনের কার্যকলাপ নিয়ে বিশদে লিখতে গেলে সেটা আরেকটা বই হয়ে যাবার সম্ভাবনা, তাই এই পরিসরে উহ্যই রাখলাম। সংক্ষেপে বলা যায়, ওদের যে পরব ছিলো এই সময়টাতে, সহরায় পরব (আরো অনেক নাম আছে), সেই উপলক্ষ্যে মাটির বাড়িতে নতুন মাটির প্রলেপ লাগানো, আর তার উপর রঙ দিয়ে ছবি আঁকা – এই কর্মযজ্ঞে সব বাচ্চারা সামিল হয়েছিলো, আর তার সঙ্গে আমরাও।
নির্মল আনন্দ কথাটা অনেকবার শুনেছি জীবনে, তবে সেটা অনুভব করতে আমার চিরকালই বড্ড ভালোলাগে।
বাচ্চাদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা, ওদের সারল্য থেকে অনেক কিছু শেখা, বিকেলে মাঠে জমিয়ে ফুটবল খেলা, পাশের গ্রাম আরশা থেকে গোটা পঞ্চাশ লোকের খিচুড়ি আর মাছের জন্যে বাজার করা, খিচুড়ি রান্না করা, আশ্রমের সামনের টিলার উপর তাঁবু খাটিয়ে থাকা, সামনের ধানক্ষেতের পেছনে দূরের টিলার পেছনে অস্তগামী সূর্যের কমলা আলোয় দিগন্তের রাঙিয়ে যাওয়া, আর সেদিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধে বসে থাকার মধ্যে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা – কেটে গেলো এভাবেই আর দুটো দিন।
দুটো মায়াময় দিন!
ভবঘুরেদের একটা মুশকিল হচ্ছে, তারা মায়ার বাঁধন থেকে পিছলে যায়। জানি, কথাটা আরেকটু কাব্যিকভাবে বলা যেত হয়ত, কিন্তু প্রকৃত ভবঘুরেও বা হতে পারলাম কই! যেদিন হবো, সেদিন কাব্যি করবো নাহয়, আপাতত এতেই কাজ চালিয়ে নিন!
তাই, মায়ার বাঁধন কাটিয়ে, আবার বেরিয়ে পড়ার পালা। তবে এবার ঘরমুখো। কিছু কাজ পড়ে আছে, পরবর্তী লম্বা সফরের আগে সেগুলো সেরে ফেলাটা একান্ত প্রয়োজন। তাই ইচ্ছে না থাকলেও, ঘরে ফিরতে হবে।
আবার এক ভোর, আবার এক সফর।
ভোররাতের, মাঠের উপর ছেয়ে থাকা ঘন গ্রাম্য কুয়াশা ভেদ করে আবার চলতে শুরু করল আমার সাইকেলের চাকা। তবে এবার পথ একটু আলাদা। ফেরার পথ বেছেছিলাম অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের, আসার পথের তুলনায়। কারণ একবার ঘরমুখী হলে, আর কোথাও রাত্রিবাসের ইচ্ছে জাগে না, সোজা ঘরের বিছানাই শ্রেয় আমার কাছে।
আমার ফেরার পথ ছিলো বাঁকুড়া–বিষ্ণুপুর–আরামবাগ–ডানকুনি হয়ে। শুনেছিলাম রাস্তা খুব ভালো, অন্তত বিষ্ণুপুর অবধি। ঠিকই শুনেছিলাম, রাস্তা বড়ই মনোরম। বারবার মনে হচ্ছিলো রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোতে দাঁড়াতে, কিন্তু আজ হাতে সময় কম, প্রায় ২৭০ কিমি পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছতে হবে, অন্তত ১৫–১৬ ঘণ্টা লাগবেই, সুতরাং চালাও পা! তাড়াহুড়ো করলে রাস্তা উপভোগ কমই করা যায়, আমি তার ব্যতিক্রম নই। তাই ফেরার পথের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কমই। দুটো ঘটনার উল্লেখ করবো তবু, একটি বেশ রোমাঞ্চকর, আরেকটি দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর।
জয়পুরের জঙ্গল পেরোবার রাস্তাটি, আপনাদের মাইরি বলছি, অতি উপভোগ্য, গা ছমছমে অথচ উত্তেজনাময় ধরণে। এই সেই জঙ্গলমহল। হাতী চলার রাস্তাও বটে। দুপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারির মাঝ দিয়ে মসৃণ রাস্তা, আর সেখান দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলোতে সাইকেল চালাতে চালাতে মনে হচ্ছিলো, এই অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি বোধহয় আর একমাত্র ফেলুদার সঙ্গে বেরলেই পাওয়া সম্ভব!
আপনারা যদি এই জায়গাটা উপভোগ করতে চান, জঙ্গল শুরু হবার ঠিক আগেই আছে এক থাকার জায়গা, বেশ সুন্দর লাগলো বাইরে থেকে, নাম “বনবিতান“, ঘুরে আসতে পারেন, মনে হয় দিব্যি লাগবে।
এ তো গেলো একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আর এর পরেরটা হল ডিনার করে আবার চালাতে শুরু করার পর, আরামবাগের কিছুটা পর থেকে। কেন আরামবাগ থেকে বেরোলাম জানি না, কারণ পরবর্তী ওই রাস্তায়, প্রায় ২০–২৫ কিমি, আমার জীবনের সব আরাম হারাম হয়ে গেলো। আমার মনে হয় ওই রাস্তায় হাতীরও চলতে কষ্ট হত! আমি জানি না ঠিক কোন দেবতার দয়ায় আমার সাইকেল, ওই রাস্তায়, একবারও পাংচার না হয়ে পেরিয়ে গেলো, কিন্তু ততক্ষণে আমার গোটা দেহ ভস্বীভূত, থুড়ি ভস্বের মত ধুলোয় মাখামাখি, আর আমি চোখে সর্ষেফুল দেখছি।
আজ্ঞে, এটাই ছিলো দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর ঘটানাটা!
এর পরে আর বেশী কিছু বলার থাকতে পারে না, কারণ এই ব্যাপারটা ভাবলেই আমার ক্লান্ত লাগছে, বাড়ির সোফায় আরাম করে বসেও!
রাস্তার অবস্থা ভালো হবার পর, ঠিক কিভাবে আমি পরবর্তী ৫০ কিমি মত দূরত্ব পেরিয়েছি, সেটা মা গঙ্গাই জানেন। ক্লান্ত দেহের থেকে বেশী ক্লান্ত মস্তিষ্ক! বারংবার চা খেয়ে, চায়ের দোকানের পাশে বাঁশের লম্বা বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে, ফুটপাথে এলিয়ে বসে, অবশেষে ডানকুনির মোড় নজরে আসাতে, ধড়ে যেন প্রাণ এলো। যাক, বাড়ির চৌহদ্দিতে এসে গেছি, আর চিন্তা নেই।
নিজেকে জ্ঞান দিলাম – “শরীরের থেকে মনের জোর বেশী দরকার, বুঝলি ভাই?”।
আমার ভেতর থেকে যে উত্তরটা এলো, সেটা এখানে লেখার উপযুক্ত নয়, তাই ক্ষমা করবেন।
ঠিক রাত বারোটা, এবং আমার বারোটা, বাজার মিনিট পাঁচেক বাকি থাকতে পৌঁছলাম বাড়ির দরজায়!
আহহহ!
বাড়ির দরজা, বাড়ির বিছানা, বাড়ির উষ্ণতা! এই অমোঘ আকর্ষণ যেন মধুর মত মনের মধ্যে চুইয়ে পড়ছিলো। আর দেরী করিনি, সাইকেল যথাস্থানে রেখে, গরম জলে শরীরের ছাইভস্ম ধুয়ে, সোজা বিছানা।
সেই মূহুর্তে, ঘরের বিছানার প্রতি যে টান, সেটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভালোলাগার অনুভূতি মনে হচ্ছিলো।
কাহিনীটা এখানেই শেষ হলে ভালো হত – তাই তো?
আমি তাই ভেবেছিলাম।
কিন্তু, ওই যে, মাথার পোকা!
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো এক সুন্দর সকালের রোদ নিয়ে। নরম বিছানা, গরম চাদর, মাথায় ভীড় করে আসা সুন্দর কাটানো বিগত দিনের ক্যালাইডোস্কোপ! সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু মনের কোণায় কোথায় যেন একটা দুষ্টু ছেলে ছটফট করতে শুরু করেছিলো এর মধ্যেই – তার চাই ঘুম ভেঙে চোখ খুলে এক পাহাড়চূড়ো, টিলার উপরের শক্ত পাথরের অসমান তাঁবুর মেঝে থেকে, আর সমুদ্রের নীল ঢেউয়ের পা ভিজিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়া দিগন্তের ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে।
কেন?
জানিনা। খুঁজছি উত্তর।
Leave a Reply