ঘুমটা কাঁচাই ভাঙলো নন্দীশের!
চটকা ভাঙলে যা হয়, খানিক ঠাহর করার চেষ্টা করলো নন্দীশ, পারিপার্শ্বিক।
ততক্ষণে চ্যাঁ চ্যাঁ করে আবার বেজে উঠেছে কলিং বেলটা।
ওহ, টেনিদা সমগ্র পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে গেছিলো, বুঝতেই পারেনি নন্দীশ। বুকের উপর থেকে খাটে পড়ে যাওয়া বইটা পাশের টেবিলে সরিয়ে রেখে খাটের পাশের দিকে পা ঝুলিয়ে উঠে বসলো নন্দীশ। তারপরেই মনে পড়ল যে বেল বেজেছে, দরজা খুলতে হবে।
উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়ল নন্দীশ। বেলটা আর বাজেনি। যে এসেছিলো, সম্ভবত সাড়াশব্দ না পেয়ে চলে গেছে। আজকাল লোকের ধৈর্য্যও এমনিতে খুব কম। গাঁক গাঁক করে বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করার ফুরসতটাও থাকে না এদের!
যাক গে, দরকার থাকলে আবার আসবে, যেই এসে থাকবে।
এমনিতেও আজকাল কেউ আসে না সেরকম, শুধু ওই পুরসভার জমাদার ছাড়া।
খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর খাট থেকে নেমে পড়লো নন্দীশ। আর ঘুম হবে না, এমনিতেও দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই একদমই।
বেসিন থেকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে ঝিম ভাবটা একটু কাটলো। রান্নাঘরের জলের ফিল্টার থেকে গ্লাসে জল ভরতে ভরতে মোবাইল ফোনটা দেখে নিলো একবার – নাহ, বেশ কিছু ফেসবুকের নোটিফিকেশন আর গুচ্ছ পুজোর শপিং এর অফার ছাড়া আর কিছুই নেই স্ক্রীণে!
জলটা শেষ করে, ফোনটা চার্জে বসিয়ে, ধীরপায়ে বারান্দায় এলো নন্দীশ। শেষ বিকেলের নরম আলো গড়িয়ে পড়ছে টবের তুলসী গাছের পাতার গা দিয়ে। হালকা হাওয়ায় দুলছিলো টবের শুকিয়ে যাওয়া ঘাসগুলো।
ভটভট করে নিচে রাস্তা দিয়ে চলে গেলো একটা মোটরসাইকেল। একটা ঘামেভেজা হলুদ পাঞ্জাবী আর নীল জিন্স পরা তরুণ তুর্কী পিছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার বান্ধবীকে।
ও হ্যাঁ, আজ তো অষ্টমী!
বহুকাল পূজোতে বাড়ি থাকে না নন্দীশ। থাকার কোনো কারণ খুঁজে পায়না আসলে।
আর তার উপরে আজকাল যা ভীড়ের বহর, তার প্রাণ আঁকুপাঁকু করে ওঠে রাস্তায় বেরোলেই।
বছর তিনেক আগে একবার ভুল করে বেরিয়ে পড়েছিলো কোনো এক পূজোর সন্ধ্যেতে, গঙ্গার ঘাটে গিয় বসবে বলে। তো, সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড! একে তো চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, কেউ বাইকে, কেউ রিক্সায়, কেউ হেঁটে, কেউ রাস্তার পাশেই থেবড়ে বসে! গুচ্ছ গুচ্ছ নবীন যুবক যুবতীর দল বাইকে করে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। আর যেসব দুর্ভাগ্যবানরা তাদের বাপকে টুপি পরাতে পারেনি, তারা হেঁটেই চরকিপাক খাচ্ছে। নন্দীশ কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলো না যে এই অগুন্তি কপোত-কপোতী হঠাৎ আজকের দিনেই উদয় হল কোথা থেকে! শ্যামাপূজোর বহ্ণি পতঙ্গ? কে জানে!
আর এর মধ্যে আরো অদ্ভুত ব্যাপারটা ছিলো এই, যে, প্রত্যেকটা বাইক চালানো বা বান্ধবীর হাত আঁকড়ে হাঁটা ছেলেরই চুলের কায়দা একই! একটা মৌচাককে আড়াআড়ি বসিয়ে দিলে যেরকম লাগতে পারে, এদের সবার চুলের কায়দাটা সেরকমই। শুধু কারুর মৌচাকের সাইজ হয়ত দশহাজার মৌমাছির চাকের মত, আর কারুর হয়ত দশকোটি।
মজারু, ভেবেছিলো নন্দীশ!
প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজে ভাবনার চটকা ভাঙলো নন্দীশের।
এক পৃথুলা মহিলা একটা গোটা টোটো ভাড়া করে, গোটা দশেক ট্রের উপর ডাঁই করে অগুনতি না-ভাজা বিভিন্ন ধরণের চপ নিয়ে গড়গড়িয়ে চলে গেলেন।
ঠিক, পূজো মানেই তো খ্যাঁটন, আর তারপরে জেলুসিল! অবশ্য, আগের মত, এখন আর খাওয়াদাওয়াটা শুধু সলিডে আটকে নেই। গ্লাস, বোতল আর বমি আজকাল পূজোরই অঙ্গ।
অবশ্য বোতল যে শুধু বমিতেই ভাসায় তা নয়, অসাধারণ কিছু শিল্পকর্মও সামনে আনে। যেমন আমাদের পাড়ারই বোতল দা – ষষ্ঠী থেকে দশমী, প্রতিদিন দুঘন্টা পানীয় সেবনের পরে, রাত দশটা থেকে ভোর চারটে অবধি, কোনোরকম বিরতি ছাড়া, একই স্টেপ এ যে অসাধারণ নৃত্যকলা উপহার দেয় পাড়াবাসীকে, তার তুলনা নন্দীশ আজ অবধি পায়নি।
টিং টিং করে ঘন্টি বাজিয়ে চলে গেলো একজোড়া সাইকেল। ছিটকাপড়ের শার্ট পরা কিশোর, আর ফ্রক পরা কিশোরী, তিরতির করে সাইকেলের চেনের আওয়াজ তুলে মিলিয়ে গেলো রাস্তার বাঁকে।
একটুকরো হাসি ফুটে উঠে উঠলো নন্দীশের ঠোঁটের কোণে।
বারান্দার কোণে রাখা চেয়ারটা টেনে হেলান দিয়ে বসল নন্দীশ। চারিদিকের বাড়িগুলোতে লাগানো টুনি আলোগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করল এক এক করে।
বারান্দার অন্ধকারটা একটু বেড়ে গেলো যেন।
সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, লাঠিতে ভর করে, ধীরগতিতে। তাদের পেরিয়ে কলকলিয়ে চলে গেলো একদল ছেলেমেয়ে।
নিঃস্তব্ধতা থমকে রইলো আলোআঁধারিময় বারান্দায়।
দিন শেষ হয়ে এলো।
সন্ধ্যে নামছে।
ঘড়িতে থেমে রইলো সন্ধিক্ষণ!
Leave a Reply to সোমনাথ Cancel reply