“আজকাল এত যে কি ভাবো তুমি, দাদা!! সেই কখন থেকে বইটা মুখের সামনে খুলে বসে আছো, পাতাটা পর্যন্ত উল্টোওনি।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বইটা ভাঁজ করে পাশের ছোট টেবিলটায় রাখলাম। আর পড়া হবে না এমনিতেও, ঝুমুর বকতে শুরু করলে ক্ষান্তি দেবে না।
ঝুমুর আমার ঘরের বারান্দায় রাখা অনেকগুলো গাছের মধ্যে একটা ছোট বনসাই ঝাউ গাছ। বছর চারেক হবে ওকে লাগিয়েছি এখানে। গাছের সঙ্গে কথা বলাটা হয়ত ভীমরতিই হবে, তবে বয়েসও তো হয়েছে। এই সামনের মাসে ৪৭ হবে।
তবে, আজকাল আর অত ভাবিনা, ভীমরতি হলেই বা আর কি করা যাবে।
“না ভেবে আর উপায় কি, নাহলে তো তুই বকে বকে আমার কানের পোকা বার করে দিবি”।
“ওওও, আমি তো শুধু বকি, তাই না!! এখন তো বলবেই!”
ঝুমুরের হাবভাব অনেকটা ছোট বোনের মত, বেশ বকাবকি করে, আর মাঝে মাঝে এরকম মান-অভিমান দেখায়।
কয়েক সেকেন্ডের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়। ঝুমুরের কথায় সম্বিত ফিরল।
“দাদা, মিচকি মিচকি হাসছো কেন বলতো?!”
নিজেই খেয়াল করিনি কখন যেন ঠোঁটের কোনে অজান্তেই হাসি লেগে গেছিল।
ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম, “কিছু না রে, এমনি”।
ঝুমুরের বয়েস বছর সাড়ে চারেক হলে কি হবে, সে মহা পাকা। গাছেদের ক্ষেত্রে সাড়ে চার খুবই অল্প বয়েস হবার কথা। কে জানে, এঁচোড় পাকাই হবে বোধহয়।
একটা ব্যাঁকা হাসি হেসে ঝুমুর বলল – “কিছু না বললেই হল!! আমি সব বুঝি।
বলো না, কারুর কথা মনে পড়ল বুঝি?”
মনে পড়া!!
নিজের মনেই হাসলাম। মনে তো তখনই পড়ার প্রশ্ন আসে যখন লোকে ভুলে যায়।
কিন্তু ঝুমুরকে এত কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। আজ বোধহয়, কেন জানিনা, ঝুমুরের ওই ছোট্ট কথাটায় মনটা অনেকদুর চলে গেছিল।
তাই বললাম, “হ্যাঁ, তা পড়ল। অনেকদিন আগে, আমার এক বন্ধু ছিল। তার কথা ভেবে হাসলাম।”
“তাই?? তা সে কিরকম বন্ধু ছিল গো? খুব কাছের বন্ধু?”
কঠিন প্রশ্ন।
মানে, ঠিক কঠিন নয়, কিন্তু সমস্যাটা এই যে উত্তরটা চট করে কাউকে বোঝানো খব মুশকিল, তাই কঠিন।
বললাম, “কিরকম বন্ধু, কি করে বোঝাই বলত? বোঝালে কি তুই বুঝবি?”
বনসাই ঝাউগাছটা দেখলাম একটু ডানদিকে হেলে গেল সামান্য। ঝুমুর বোধহয় গালে হাত দিয়ে বসল, ইন্টারেস্ট পেয়েছে নিশ্চই।
নিজের মনেই একটু হেসে আবার বললাম।
“তোর এই রাগ করা দেখে মনে পড়ল, সেও এরকম কথায় কথায় খুব রাগ করত আর ঝগড়া করত। বাচ্চাদের মতই।”
“ওয়াও, খুব ভালো বন্ধু তো গো দাদা!!?” – ঝুমুরকে খুব উত্তেজিত দেখালো।
“ভালো কি মন্দ বলতে পারব না, তবে মাথার সব চুল তুলে দিয়েছিল বটে আমার। প্রচন্ড রেগে যেত যদি তার একটুও মনে হত যে আমি কাউকে তার থেকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি। একদম ক্ষেপি।”
কেমন যেন মনে হল ঝুমুর জিভ কাটলো।
আকাশটা সকাল থেকেই মেঘলা। চারিদিকে কেমন যেন গুমোট ভাব। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। দুটো কাকা উড়ে গেল কা কা করতে করতে। রাস্তার ধারের কৃষ্ণচুড়া গাছটাতে অনেক ফুল হয়েছে, ঠিক যেন আগুন লেগেছে সমস্ত গাছটাতে।
ঝির ঝির করে কেঁপে উঠল পাতাগুলো, মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, অনেকদিন পরে।
“কতদিন আগের কথা গো দাদা?”
চটকা ভাঙ্গল ঝুমুরের কথায়। বেচারা অনেক্ষণ চুপ করে ছিল, ভাবছিল আমি কিছু বলব, কিন্তু তারপর আর ধৈর্য ধরতে পারেনি বোধহয়।
কতদিন আগে?
সময়ের হিসেব কি করে করি, যেখানে সময় থমকে আছে আজও!
ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তা হবে, আমি তখন ৩১-৩২ হব”।
ঝুমুর খানিক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করল – “তোমরা খুব গল্প করতে নিশ্চয়ই?”
“হুম, তা তো করতাম”
“কি গল্প গো, বল না”
“গল্প আর কি!! যেরকম সবাই করে সেরকম গল্প”
“দূর বাবা, এ তো আচ্ছা মুশকিল হল, গলায় কি ব্যাঙ ঢুকেছে নাকি!!” – ঝুমুরকে বেশ রাগান্বিত মনে হল।
আমি হেসে বললাম, “আচ্ছা ঝুমুর, সে গল্প কি আর একটা রে, কি করে বলি বলতো? সে অনেক গল্প, তার না আছে কোনো মাথা, না আছে কোনো মুন্ডু। বকতে বকতে যে কখন সময় পেরিয়ে যেত টেরই পেতাম না। কখনও কাজের গল্প, কখনও বইয়ের, কখনও গানের, কখনও খাবারের, আবার কখনও আমার গল্প, তার গল্প, আমাদের গল্প, বৃষ্টির গল্প, রোদ্দুরের গল্প, সবুজ উপত্যকা বা রুক্ষ মরুভুমির গল্প।”
…
…
কখন হালকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল খেয়ালই করিনি। গালে হালকা জলের ছিটে লাগতে বুঝলাম। ঝুমুরের পাতাগুলোও ভিজে গ্যাছে একটু, টুপটাপ করে জল পড়ছিল ওর পাতাগুলো থেকে।
অনেক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। কতক্ষণ সময় কেটে গেছিল তার খেয়াল ছিল না। ঝুমুরও কোন কথা বলেনি এতক্ষণ। কি ভাবছিল কে জানে!
“আসলে, আমি বোধহয় ভালো বন্ধু ছিলাম না।”
“কেন?” – ঝুমুরকে একটু গম্ভীর লাগল।
“ভালো বন্ধু তো তার বন্ধুকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, দ্বিধায় ফেলে পেছনে টেনে ধরে না”
“কেন, তুমি কি পেছনে টেনে ধরেছিলে?”
“সেটা ঠিক জানি না, তবে দ্বিধায় ফেলেছিলাম এটা নিয়ে তো কোন সন্দেহ নেই”
ঝুমুর আর কিছু প্রশ্ন করল না এটার পর। এত কঠিন কথাবার্তা শুনে ঘেঁটে গিয়েছিল বোধহয়।
আমিও ভাবছিলাম, কেন তৈরি হয়েছিল দ্বিধা।
এ পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ যখন অন্যদের সঙ্গে মেশে, কথা বলে, তাদের মধ্যে অনেকগুলো স্তর থাকে। আসল মানুষটা, যে সবসময় একটা সাদাকালো চরিত্র, সে কখনই বাইরে আসে না। তবে, কখনও কখনও, খুব কম ক্ষেত্রে, কখনও কেউ কেউ পেয়ে যায় এমন কাউকে, যার সামনে সেই আসল মানুষটা বেরিয়ে আসতে পারে নির্দ্বিধায়। আর তখন, সেই দুটো মানুষ জুড়ে যায় এমন একটা মনের স্তরে, যেটা অবিচ্ছেদ্য, আর চিরকালীন।
কিন্তু এই স্তর তো শুধু সেই দুটো মানুষের জন্যে, আর কেউ বোঝে না তার অস্তিত্ব। আর, সত্যিই তো, পৃথিবীটা তো আর শুধু দুজন মানুষকে নিয়ে চলে না।
“কি হয়েছিল, তারপর?”
“কি আবার হবে? হবার আছেটা কি এর মধ্যে?”
“নেকামো কোরো না!! আমি জিগ্যেস করছি কি হল তোমার বন্ধুর, তারপর?”
“শোন ঝুমুর, জীবনে এগিয়ে যেতে গেলে পুরোনো জিনিস অনেকসময় ফেলে দিতে হয়, বোঝা কমাতে হয়, কেটে ফেলতে হয় পুরোনো সম্পর্ক, যা কাউকে পিছনে টেনে ধরে।”
“বাহ, ছেড়ে চলে গেল?!”
“আহ ঝুমুর, বাজে কথা বলিসনা, এর মধ্যে ছেড়ে যাবার কি আছে!! যেটা বুঝিসনা সেটা নিয়ে কথা বলিস কেন?”
একটু বেশীই ঝাঁঝিয়ে বলে ফেলেছিলাম কথাটা। খারাপ লাগল ঝুমুরকে চুপ করে থাকতে দেখে।
তাই একটু পরে বললাম, “আচ্ছা চল, আমি আবার একটু বইটা পড়ি, বুঝলি?”
…
…
“থাকো তো একা, সেরকম কাছের বলতে কেউ নেই তোমার, কেউ কিছু পাঠায়ওনা তোমাকে, ওই মোটা কালো ফ্রেমের চশমাপরা দাদু শুধু মাঝে মাঝে ইমেল করে তোমাকে, আর ওই দুটো ছোঁড়াছুঁড়ি, ওই কি পিং না টিং কি বলে – সেসব করে, তাহলে, প্রতি বছর ১৩ ই জুন নিয়ম করে লেটারবক্সের চাবি খুলে কি দেখো?”
একটু হাসলাম, কিন্তু আর বললাম না ঝুমুরকে, যে, ওই একটাই এক্সপেক্টেশন আজও রয়ে গেছে। এটা একমাত্র একজন ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
মুখের উপর একটা হালকা রোদ এসে পড়ল। মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠেছে। আর গুমোট নেই চারিদিকে।
পাশের বাড়ী থেকে কেউ একটা গান চালিয়েছে। জন ডেনভার গাইছেন…
“Sunshine, on my shoulders makes me happy
Sunshine, in my eyes can make me cry
Sunshine, on the water look so lovely
Sunshine, almost always makes me high”
Leave a Reply