পশ্চিমবাংলার বাইরে, বিশেষত দক্ষিণে আর পশ্চিমে, বাঙালীদের নিয়ে একটু-আধটু খিল্লি যে হয়ে থাকে এটা সবার-ই জানা, যেমন আমরা ওদের নিয়ে করে থাকি আর কি।
তা, “কুঁড়ে”, “ভাবুক-চন্দর”, “বাবু”, এই মধুর তকমাগুলো বাঙালীদের সম্বন্ধে শুনলে এঁড়ে তক্ক করা ছাড়া আর কিছু করার খুব একটা থাকে না।
কিন্তু একটা ব্যাপার আছে, যেখানে এঁড়ে-বেঁড়ে যে তক্কোই হোক না কেন, কেউ কিছু বললে মাঝে মাঝে রক্তারক্তি হয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে।
“মেছো-বাঙালী” – আমার সমস্ত অবাঙালী বন্ধুরা এবং বাকিরা – ভেবেচিন্তে বলবেন, মাইরি বলছি।
গড়পড়তা বাঙালীর পাতে মাছ থাকাটা রোজকার ব্যাপার।
রুই-কাতলা-মৃগেল-ভোলা-ভেটকি-পাবদা-তেলাপিয়া-পমফ্রেট-চিংড়ি-ইলিশ, এসব বাঙালীর জীবনের নিত্যসঙ্গী।
যেকোনো দুই বাঙালীকে মাছ নিয়ে কথা বলতে বসিয়ে দিন, গোটা একটা বেলা কেটে যাবে, কিন্তু তাও আগামী এক মাসের যুক্তিতক্কো বাকি থাকবে।
আর, এই মাছেদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ আছে, অনেকটা ওই বামপন্থী রাজনীতির মত (আমি কিন্তু রাজনীতির ব্যাপারে মূর্খ্যই বলতে পারেন, তাই দয়া করে মানহানির মামলা করবেন না)।
রুই-কাতলা-মৃগেল-মৌরলা – এরা হচ্ছে ওই শ্রমিক-কৃষক শ্রেণী। শ্রেণী রাজনীতি নিয়ে এর থেকে বেশী জানতে চাইলে, মার্ক্সবাদ পড়ে নেবেন, আর মাছ নিয়ে আরও জানতে চাইলে বলবেন – পরে আর একটা নাহয় লিখব সব মাছেদের নিয়ে।
পমফ্রেট-পাবদা-ভোলা-ভেটকি – এরা হল ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তবে পুঁজিবাদী বোধহয় বলা যায় না এদের।
আর, ইলিশ-চিংড়ি, এরা হল মাছেদের সমাজে এলিট শ্রেণী।
বোধহয় একটু ভুল বললাম।
এরা মাছেদের সমাজে নয়, মনুষ্য সমাজের ক্ষেত্রেই শ্রেণী বিভাজনটা করে থাকে সাধারণত। তবে, সেই কচকচি আরেকদিন হবে নাহয় পরে।
কিন্তু, এই যে ইলিশ-চিংড়ি, এরা হল গিয়ে আইকনিক, মেগা-স্টার বলতে পারেন।
এদের নিয়ে বাঙাল-ঘটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান – এরকম হাই-ভোল্টেজ ক্যাচড়া তো অতি পরিচিত বাঙালী সমাজে।
তবে, যেটা কোনদিনই খুব একটা তক্কে আসে না, সেটা হল শুঁটকি মাছ।
এই বস্তুটি কিন্তু পূর্ববঙ্গের লিগ্যাসি। বাঙালদের খাস বিলাসিতা বলতে পারেন।
এরকম একটা বিতর্ক তো আছেই যে, পদ্মার ওপারে বাঙাল, আর এপারে নয়।
আমি কিন্তু এপার-ওপার কোনটাই নই, জন্মও বাংলাদেশে নয়, কিন্তু জন্মসূত্রে বাঙাল বটে।
আর শুঁটকি মাছ আমার জীবনের সেরা খাবারগুলোর মধ্যে একদম উপরে আছে। আর আমি কিন্তু বহু জায়গার বহু খাবার খেয়েছি, আমাকে কুঁয়োর ব্যাঙ ভাববেন না মোটেও।
তাই, বাঙাল আর শুঁটকি মাছ যে একাত্মা, এই ব্যাপারে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। সুতরাং, আপনি যদি নিজেকে বাঙাল মনে করেন, কিন্তু শুঁটকি মাছ ভালো না বাসেন, দয়া করে ঘরের কোনায় গিয়ে মুখ লুকোন, কারণ এই নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসলে আপনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে এটা আগেই বলে দিলাম কিন্ত।
তো, যাই হোক, এই শুঁটকি মাছ জিনিসটা বেশ মজার। একটু বলি বরং।
সাধারণত, লৈট্যা, লাক্কা আর চিংড়ি – এই তিন ধরনের মাছ থেকেই শুঁটকি তৈরি হয়। ব্যাপারটা কিছুই নয়, এই মাছগুলোকে বেশ অনেকদিন ধরে তেড়ে শুকোনো হয়। তারপর যখন মাছগুলোর মধ্যে আর কোন রসকষ বাকি থাকে না, তখনই ওগুলোকে বাজারে পাঠানো হয় খাদ্যরসিকদের রসনার রসস্বাদন করার জন্যে।
এই শুঁটকি মাছের বেশ চড়া দুর্নাম আছে মার্কেটে। কারণটা বুঝতে আমার ছোটবেলায় বেশী সময় লাগেনি, ঘটনাটা একটু বলি।
বাড়িতে শুঁটকি মাছ রান্না হচ্ছে একদিন সকালে। ভাড়া বাড়ী ছিল, আমরা নিচের তলায়, বাড়িওলরা উপরে। রান্না তখন মাঝামাঝি জায়গায়, চারিদিক বেশ ম-ম করছে, হঠাৎ দেখি বাড়িওয়ালা মাসিমা নাকে কষে আঁচল চাপা দিয়ে নিচে নেমে এসেছেন, আর আমার মা-কে বলছেন – “আঁরঁতিঁ, তোঁমাঁর রাঁন্নাঘঁরে কিঁ কিঁছুঁ পঁচেছেঁ? আঁমরাঁ উঁপর থেঁকেঁ এঁকটা ভঁয়ঙ্কঁর মঁড়াপঁচা গঁন্ধ পাঁচ্ছি।”
খুব একটা অতিরঞ্জিত ছিল না বোধহয় ব্যাপারটা। আসলে, যারা কোনদিন এই বস্তুটির সঙ্গে পরিচিত হয়েনি, তাদের ক্ষেত্রে শুঁটকি মাছ রান্নার সময়ের গন্ধটা সহ্য করাটা অনেকটা ভুতেদের মোচ্ছবে বসে থাকার মতই লাগে হয়ত।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার চরম লাগত ওই গন্ধটা।
শুঁটকি মাছ রান্নার গন্ধ নাকে ঢোকা মানেই আমার খিদে পাওয়া শুরু। সেই খিদে ওই যে সকাল ১০-১১ টা থেকে পেতে শুরু করত, আগ্নেয়গিরির লাভার মত সেই খিদেটা ১-টা নাগাদ দুপুরের খাবার পাতে বিস্ফোরন হত। রোজ যা ভাত খেতাম, এই দিনটাতে তার থেকে অন্তত দ্বিগুণ খাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
খাওয়ার পাতে, ওই যে একটা লালচে, তেল-রগরগে, বিষম ঝাল বস্তু পাতে এসে পড়ত, তার যে কি স্বাদ, সে যে কি জিনিস, মাইরি বলছি, আমার অত ক্ষমতা নেই যে সেটা আপনাদের লিখে বোঝাব।
সেটা বুঝতে গেলে আপনাদের ওই স্বর্গীয় বস্তুটির রসস্বাদন করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।
বেশ অনেক রকম শুঁটকি মাছের রান্নাই আমি খেয়েছি, এদিক-ওদিক অনেক বাঙালদের হাতে, কিন্তু, মা যেটা বাড়িতে বানাতো, সেটা একটা অন্য জিনিস ছিল, একদম অন্য জিনিস।
অনেকবার মা খাইয়েছে সেই শুঁটকি মাছ।
একদিন বলল, আগামী রবিবার করব, আসিস খেতে।
সেই রবিবারটা এসেছিল ঠিকই, কিন্তু শুঁটকি মাছ রান্না করার জন্যে মা আর ছিল না।
স্বাদটা চিরকাল মনে থাকবে।
তাই কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, যে অনেকদিন খাওয়া হয়নি, একদিন চেষ্টা করেই দেখি না রান্না করার।
রান্না তো আর শুধু রেসিপি নয়, তার সঙ্গে স্মৃতিও, হয়ত ওরকমই বানিয়ে ফেলব।
Leave a Reply